সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থি যে কোনো আইন প্রণয়ন বন্ধ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিও জানানো হয়েছে।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকল প্রকার মানবাধিকারের চালিকাশক্তি’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ দাবি জানানো হয়।
সভায় সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্ত গণমাধ্যমের কণ্ঠস্বর রোধ করে এমন ৯টির মতো আইন বর্তমানে দেশে কার্যকর রয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত প্রেস কাউন্সিল আইনসহ এ ধরনের আরও ৪টি আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সম্পাদক পরিষদ বারবার সরকারকে প্রস্তাবিত প্রেস কাউন্সিল আইনের খসড়া কপি শেয়ার করার আহ্বান জানালেও সরকার এখন পর্যন্ত তাতে সাড়া দেয়নি।
সরকারকে এ ধরনের ‘গোপন রাখার সংস্কৃতি’ থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে মাহফুজ আনাম বলেন, ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সময় বলা হয়েছিল এগুলো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না। কিন্তু ৫ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি, এ আইন প্রয়োগ হচ্ছে স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে।
সম্পাদক পরিষদের অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে—ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার এবং এ আইনের অধীনে গ্রেপ্তার সব সাংবাদিকের মুক্তি। সম্পাদক পরিষদের প্রত্যাশা, সাংবাদিকদের জন্য দেশে যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, সেটি সরকার উদ্যোগী হয়ে যেন একবারেই মুছে ফেলে। সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন প্রণয়নের জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবীর বলেন, মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশ ও সংবাদপত্রে দেশের অসঙ্গতি নিয়ে যারা লিখতে চান, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে ভিন্নমত পোষণ করা যায় না। অনুনয়-বিনয় করে কোনো লাভ নেই। আমরা সরকারের সঙ্গে বহুবার কথা বলেছি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে, কিন্তু কিছুই বদলায়নি। এ আইন হয়েছে।
ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, আমার এখন কথা বলতে ভয় লাগে। কারণ মিস ইন্টারপ্রেট (ভুল ব্যাখ্যা) করে। যুগে যুগে সব শাসকই সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করে এসেছেন। বিভিন্ন সময় ইত্তেফাক পত্রিকাও বন্ধ করা হয়েছিল।
সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, শুধু আইনের দোহাই দিলেই হবে না। এখন পেশাদার সম্পাদক আর মালিকের সম্পাদকের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। কে পেশাগত কাজ করছে আর কে মালিকের স্বার্থের জন্য কাজ করছে সেটাও বুঝতে হবে।
সমকালের সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেন, আমরা যারা সাংবাদিকতায় কাজ করছি আমরা জানি কী অবস্থায় কাজ করছি। পেশা আজ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও আমাদের সেই লড়াই করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকার অনেক সময় বলে এই সময়ে সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা আছে। শহর ও গ্রাম থেকে হাজার হাজার পত্রিকা বের হচ্ছে। সংখ্যা যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মানদণ্ড হতো তাহলে পঙ্গপাল হতো সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী। সংখ্যা দিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নির্ধারণ করা ভুল।
ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ বলেন, এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সরকারের মধ্যেও এই আইন নিয়ে অস্বস্তি আছে। তারা বলছে এটা সংশোধন করবে, কিন্তু করছে না।
সভাটি সঞ্চালনা করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস বিশ্বব্যাপী প্রতিটি সরকারকে মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সভায় আরও বক্তব্য দেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক ও দেশ রূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুন।