সবুজ গ্রাম বাংলার মোহনীয় ও সুপরিচিত রূপে হৃদয় জুড়িয়ে যায়। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত অমূল্য সম্পদ, যা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলেছে কুটির শিল্প।
জরাজীর্ণ বাড়ির পাশে মেয়ে ঝর্ণাকে নিয়ে সংসার চালাতে বিরামহীন তাঁত বুনছেন ৪ সন্তানের জননী রেনুয়ারা বেগম। তার পরিবার হোগলা পাতার দড়ি দিয়ে তৈরি সুন্দর ঝুড়ি তৈরি করে।
এক সময় দিনমজুর স্বামী ও সন্তানদের পেটপুরে দুবেলা খাওয়ার কষ্ট হলেও এখন তার আয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। তার হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় সমৃদ্ধ সব কুটির পণ্য যা বিক্রি করে সংসার চলে, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচও চলে এই শ্রম দিয়ে।
ময়মনসিংহের গ্রামীণ জনপদের হতদরিদ্র মানুষ হোগলা পাতার তৈরি বাহারি হস্তশিল্প তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। শুধু তাই নয়, এসব পণ্য ইউরোপ, আমেরিকা ও চীনসহ বিশ্বের ৮২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বেসরকারি রপ্তানি ফ্যাক্টর শিল্পগুলো বলছে, সরকারি সহযোগিতা পেলে বিদেশি উৎসবে দেশি পণ্যের অংশগ্রহণ সহজ হবে, অর্ডার বাড়ানোর পাশাপাশি পণ্য রফতানি করেও আশানুরূপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে।
ময়মনসিংহের আরেকটি প্রত্যন্ত গ্রাম ভালুকজান। একসময় দারিদ্র্যতা ছিল এখানকার মানুষের জীবন সঙ্গী। পুরুষরা প্রতিদিন কাজ করলেও নারীরা ঘরের কাজ শেষে অবসর সময় কাটাতেন। কিন্তু এখন বদলে গেছে প্রতিটি বাড়ির উঠোনের চিত্র।
প্রতিটি বাড়িতে হোগলা পাতার হস্তশিল্প তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তাদের হাতে তৈরি পণ্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্তত ৮২টি দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ভালুকজান, কয়ারচালাসহ চারটি গ্রামের আড়াইশ পরিবারের হাজার হাজার উদ্যোক্তা ও কারিগর এ কাজে জড়িত। বছরে ১২০ ধরনের পণ্য উৎপাদিত হয়, যার বাজার মূল্য বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা।
রাস্তা সংস্কার হলে বেচাকেনা দ্বিগুণ হতো বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। তবে নিত্যদিনের পণ্যের বাজারমূল্য বেশি থাকায় মজুরি বাড়ানোর দাবিও কারিগরদের।
‘বিডি ক্রিয়েশন’ নামে বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০১৩ সালে, এই প্রতিষ্ঠানটি প্রথম ময়মনসিংহ বিভাগের 8টি জেলায় কাজ শুরু করে। সারাদেশের মতো ফুলবাড়িয়া উপজেলায় গ্রামের নারী-পুরুষদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিটি ঘরে ঘরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা গড়ে তোলা হয়েছে। কর্মসংস্থানও বেড়েছে।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিডি ক্রিয়েশনের অপারেশন ম্যানেজার মোতালেব হোসেন বলেন, গত অর্থবছরের হোগলাপাতা, বাশ, বেতসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প মিলিয়ে ২০০ কোটি টাকার পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে পেরেছে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর ফেস্টিভালে দেশে তৈরী এই সমস্ত পণ্য প্রদর্শন সহজলভ্য করা গেলে পণ্যের বিক্রি পাশাপাশি আয় বৃদ্ধি পাবে। এতে তৈরী হয় ফুলের টব, কিচেন বাক্সেট, টিস্যু বক্স, বিড়ালের বাস্কেট, ক্যারেট, শপিং বাক্সেট, ফ্লোর মেটসহ কুটির শিল্পের নান্দনিক বাহারি সব পণ্য।
উদ্যোক্তারা জানান, পণ্যে ব্যবহৃত হোগলা পাতার দড়ি বরিশাল, নোয়াখালী থেকে কেনা হয়। পরে নিজ নিজ এলাকায় দক্ষ কর্মীদের মাধ্যমে ফরমেট অনুযায়ী তৈরি পন্য সাপ্লায়ারদের সরবরাহ করা হয়।
সাম্প্রতিক ফুলবাড়িয়ার ভালুকজান গ্রামে হোগলাজাত পন্যের প্রসারে বিআরডিবি জীবিকায়ন পল্লীর উদ্ভোধন করেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্রাচার্য্য।
তিনি বলেন, গ্রামের অসহায় পুজিহীন মানুষদের সাবলম্বী করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে, সেই সাথে প্রকৃত উদ্যোক্তাদের খুঁজে বের করে তাদের সহায়তা করা হবে।
বিডি ক্রিয়েশন দেশের ১৩টি জেলায় হস্তশিল্প ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই হস্তশিল্প প্রকল্পে দেশের প্রায় ৫ লাখ উদ্যোক্তা ও কারিগরের কর্মসংস্থান হয়েছে।