ছোটবেলায় আমরা সবাই কম বেশি বাজি ধরেছি । শৈশবের স্মৃতিমাখা সে সময়গুলো অনেকেরই হৃদয়’কে নাড়া দেয় । সেসময় কিশোর যুবারা বাজি ধরতেন গাছের মগডাল থেকে ফল সংগ্রহ, খাবার খাওয়া , কায়িক শ্রম দেওয়া , কে কত দূর নদীতে সাতার কিংবা কতক্ষণ ডুব দিয়ে থাকতে পারে । সময় পাল্টেছে । সমাজের মানুষের যাপিত জীবন সহজীকরণে সকলের হাতে হাতে পৌছেছে হালের স্মার্টফোন কিংবা টাচ মোবাইল । ইন্টারনেটের বদলে হাতের মুঠোয় বিশ্ব ।
বাজি নিছক চিত্তবিনোদন থেকে রূপ নিয়েছে নেশায় । সনাতনী আমলের বাশবাগান কিংবা মাঠের কোণায় , ঝোপের আড়ালে গোল হয়ে বসে তাস খেলার মাধ্যমে জুয়ার আসর এখন হিমঘরে । জুয়ার আরে এখন বসে অনলেইনে । কষ্ট করে , গোপনে দূরে কোথাও গিয়ে খেলার প্রয়োজন পড়ে না ; হাতের মুঠোয় ইন্টারনেট সংযোগ সহ মোবাইল ফোন থাকলেই খেলা যায় জুয়া । সদ্য হাইস্কুল পড়ুয়া স্কুল ছাত্র , কলেজগামী কিশোর , বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষিত যুবক, বিভিন্ন পেশাজীবি , দিনমজুর সবাই খেলছেন অনলাইন বেট বা জুয়া ।
সাধারণ সংজ্ঞায় – জুয়া হলো কারো সাথে হার-জিত চ্যালেন্জ করা । কমপক্ষে দুইটি পক্ষের মধ্যে বাজি ধরা হয় । বিজয়ী নগদ অর্থ বা বিনিময়মূল্য আছে এমন কিছু অপরপক্ষের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন । সুতরাং , জুয়া বা বাজী হচ্ছে এমন একটা খেলা যা লাভ বা লোকশানের মধ্যে ঝুলন্ত থাকে। জুয়া খেলায় মূলত নির্দিষ্ট পরিমানের অর্থ বা বস্তু (যা পুরস্কার হিসেবে ধার্য করা হয়) নির্ধারণ করা হয়। তারপর কোনো একটি বিষয়ে দুই পক্ষ চুক্তি করে হার জিত নির্ধারণ করে। যে পক্ষ হেরে যায় সে অপর পক্ষকে সেই নির্ধারিত অর্থ বা বস্তু প্রদান করে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশেও জুয়ার নয়া সংস্করণ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে । উত্তরের মফস্বল শহর বগুড়াতে এর প্রকাশ্য প্রভাব লক্ষ্যনীয় । বাংলাদেশে জুয়া খেলা নিষদ্ধ হলেও ডিজিটাল মাধ্যমে নতুন রূপ পেয়েছে । জেলা শহরটিতে জুয়াড়ীরা দলবদ্ধ কিংবা একক ভাবে অংশ নিচ্চে অনলাইন জুয়ায় । ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলার ফলাফল নিয়ে সবচাইতে বেশী অনলাইন জুয়া খেলা হয় । সদ্যশেষ হওয়া আইপিএল ক্রিকটে টূর্ণামেন্ট নিয়েও প্রকাশ্যে মোবাইল ফোনে জুয়া খেলেছে বগুড়ার জুয়াড়ীরা ।
ডিজিটাল মাধ্যমে জুয়া নতুন বেগে ছুটছে । ঘরের কোণায় বসে খেলা চলায় অভিভাবক , আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও টের পাচ্ছে না জুয়া হচ্ছে কোথায় ? মোবাইলে ফেসবুক এ্যাপ চালু করলেই বিজ্ঞাপন আকারে দেখা যায় একাধিক অনলাইন জুয়ার পেজ। ফেসবুক আইডি, পেজ, গ্রুপ, ওয়েবসাইট । মোবাইলভিত্তিক অ্যাপ দিয়ে চলছে এই জুয়ার সাইটগুলো। বিদেশি আয়োজনে এসব জুয়ার সাইট চললেও এখন দেশিয় অনেক প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই মারাত্বক জুয়ার বিভিন্ন সাইটের মধ্যে Blackjack, Roulette, Pocker, Baccarat, keno, Craps, Sic bo, Video poker, Slotomania, Teen patti, 1xbet, 22bet, most bet, 888 casino, Betwinner, GGbet, Loft.Casino,1WIN, William Hill, Leo Vegas Casino অন্যতম।
ভয়াল অনলাইন জুয়ার নেশায় ধ্বংস হচ্ছে বগুড়ার উঠতি বয়সী যুব সমাজ, পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে উঠতি বয়সী যুবকদের লেখাপড়া। অনেকে জুয়ার টাকা জোগাড় করতে বেছে নিচ্ছে চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো মারাত্বক অপরাধের পথ, ফলে সমাজে বিরাজ করছে এক ধরনের অস্থিরতা। টাকা পয়সা অনলাইন জুয়ায় নষ্ট করে পারিবারিকভাবে অশান্তিতে ভুগছে। বাড়ছে পারিবারিক কলহ। চরমভাবে বিপদগামী হচ্ছে তারা এই সর্বনাশা জুয়ার টাকার জোগাড় করতে।
অনলাইন জুয়ার বাস্তবতা বুঝতে কয়েকজন অনলাইনে বাজিধরা কিমোরের সাথে কথা হয় । তাদের দেওয়া তথ্যমতে প্রথমে বন্ধুদের কাছ থেকে এসব তথ্য পায় তারা এরপর মূল জুয়াড়ীদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকে । খেলার ফলাফল দিয়ে বাজি ধরতে ধরতে নিজের অজান্তেই মূল অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে তারা । প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জুয়ার বিজ্ঞাপনও প্রভাবিত করে তাদের । টিউশন মানি শিক্ষককে না দিয়ে , স্কুর-কলেজ বেতন বকেয়া রেখে , বাবা-মায়ের পকেট কেটে শুরু করলেও ‘বড় দানের ‘ লোভে অনৈতিক ভাবে অর্থযোগানোর পদ্ধতিও পাল্টাতে তাকে । ধার নেওয়া, চুরি, ছিনতাই ,ডাকতি , সুদের মাধ্যমে নগদ অর্থ নেওয়া , নিজের ব্যবহৃত বাই –মোটর সাইকেল বন্ধক রাখা , মায়ের-স্ত্রীর গহণা বন্ধক রেখেও জুয়া খেলছে তারা ।
স্কুল কলেজ শেষে , প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার নাম করে অভিভাবক-শিক্ষকদের ফাকি দিয়ে শহরের অভিজাত এলাকাগুলোর গলির মুখে, আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে, সন্ধ্যায় জেলা স্কুলের মাঠে , কিংবা শহর জুড়ে পাড়া মহল্লায় গরে ঘরে চোখ কান খোলা রাখলেই শোনা যায় জুয়াড়ীদের ফিসফাস লক্ষ্য করা যায় তাদের মতিগতি । কিছুদিন আগেও যে খেলতো ফ্রি ফায়ার-পাবজির মতো অনলাইন গেম সে এখন অনলাইন জুয়াড়ী ।
জুয়ার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া বিবাদ , হাতাহাতি নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা । শহরের সূত্রাপুর , বাদুড়তলা , লতিফপুর কলোনী , জহুরুলনগর, চকসূত্রাপুর চামড়া গুদাম , মালগ্রাম , খান্দার , ফুলতলা , ফুলবাড়ী কলেজ রোড, জলেশ্বরীতলা, মফিজ পাগলার মোড় সর্বত্রই ছোট-বড় জুয়ার জটলা । বসে দাড়িয়ে চলছে আড্ডা চা-সিগারেট আর মোবাইল স্ক্রীনে স্ক্রলিং ।
অনলাইনের জুয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে যেমন বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্চে সেইসাথে ধ্বংস হচ্ছে আমদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম । ফেসবুক, ইউটিউবে প্রচারণা থাকায় সবাই ঝুকছে জুয়ায় । জুয়া রোধে বাংলাদেশে বহাল রয়েছে ব্রিটিশ আমলের ১৮৬৭ সালের আইন । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ এর সংবিধানে জুয়া খেলা নিরোধ করা হয়। সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশের জুয়া প্রতিরোধে প্রচলিত আইনেও জুয়া খেলা অবৈধ।এতে সাজার পরিমাণও খুব নগণ্য। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যে কোনও ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনও সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
এ রকম কোনও ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনও ব্যক্তিকে জুয়া খেলারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। অর্থাৎ এই আইন শুধুমাত্র প্রকাশ্য জুয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং দণ্ডবিধি বর্তমান বাস্তবতার সাথে উপযোগী নয় বলেই পুলিশের মত। ২০১৯ সালে রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে বিভিন্ন জুয়ার আসর থেকে শতাধিক ব্যক্তি আটক হলে আইনের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি তখন আলোচনায় আসে।তখন অবশ্য এই আইনে কোন মামলা দেয়া হয়নি। তবে ১৫৬ বছরের পুরনো আইন সংশোধন করে একে যুগোপযোগী করা জরুরি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শুধু বগুড়া জেলা নয় আশেপাশের উপজেলা ,গ্রাম ,হাট বাজার গুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদকের তেকেও বেশী আসক্তি সম্পন্ন এই অনলাইন জুয়া । গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণর জন্য কেবলমাত্র ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট বাস্তবায়ন না করে বাংলাদেশে ডিজিটাল জুয়াকে রুখতে ডিজিটাল এ্যাক্ট প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন সুধীজনেরা ।