আজ ৫ই জুন বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সংগীতের ‘গুরু’ আজম খানের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার গানের বিশেষত্ব ছিল পশ্চিমা ধাঁচের পপ জনরায় দেশ ও মানুষের জীবনের আবেগ বাস্তবতা তুলে ধরার স্বতন্ত্র রীতি। ২০১১ সালের এই দিনে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান মুক্তিযোদ্ধা ও কিংবদন্তি এই সংগীত তারকা। রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। তাঁর কাছের বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বরেণ্য গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর। নীরবে, নিভৃতে চলে যাচ্ছে গুরু আজম খানের প্রয়াণ দিবস। সংগীতের সঙ্গে যুক্ত কোনো সংগঠন এই কিংবদন্তির স্মরণে আজ কোন আয়োজন করেনি।
জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার আজিমপুর কলোনির ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টারে। তার পুরো নাম মাহবুবুল হক খান। শৈশবের পাঁচ বছর কাটে আজিমপুর কলোনিতে। আফতাব উদ্দিন আহমেদ ও মা জোবেদা খাতুনের পরিবারে তারা ৪ ভাই ও এক বোন ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি করে স্থায়ী নিবাস গড়েন।
১৯৬৯ সালে তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং গণঅভ্যুত্থানের সময়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসংগীত প্রচার করেন।
১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে এইচএসসি পাশ করে মাত্র ২১ বছর বয়সে ঢাকা উত্তরের সেকশন কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ করেন দুই নম্বর সেক্টরের একটি সেকশনের ইনচার্জ হিসাবে ও সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ।
ঢাকায় তিনি সেকশন কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। অপারেশন তিতাস ছিল অন্যতম। ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, হোটেল পূর্বাণীর গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটিয়ে ওই সব হোটেলে অবস্থানরত বিদেশিরা যাতে বুঝতে পারানো যে দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। অপারেশন তিতাসে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন, যা পরবর্তীকালে তার শ্রবণক্ষমতায় বাধাপ্রাপ্ত করে। আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় দখল করেন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংঘটিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন। তাদের অংশগ্রহণ করা এই দুর্ধর্ষ গেরিলা দলের নাম ছিল ক্র্যাক প্লাটুন।
তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ পুত্র শাফী ইমাম রুমীর কাছে এলএমজি, রাইফেল চালানো। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে লেখা ছিল , ‘২০শে আগস্ট, ১৯৭১ একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর: হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ- বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।’
তাঁর সংগীতজীবনের শুরু প্রকৃতপক্ষে ষাট দশকের শুরুতে।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লাকী আখন্দ ও হ্যাপি আখন্দ ও আরও কয়েক জনকে নিয়ে তিনি প্রথম গড়ে তোলেন ব্যান্ডদল ‘উচ্চারণ’। বন্ধু নিলু ও মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকালিস্ট করে অনুষ্ঠান শুরু করেন তিনি। ১৯৭৪-৭৫ সালে আজম খানের গাওয়া গান ‘হায় রে বাংলাদেশ’ সংগীতপ্রেমীদের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের হৃদয় জয় করে নেয়। এলাকার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। পরবর্তীকালে তার মাধ্যমে পরিচিত হন ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজের সাথে এবং সবাই একসাথে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করেন তারা। এরই মধ্যে আরেক বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড-রক জনরার গান জীবনে কিছু পাবো না এ হে হে….! আজম খানের দাবি, এটি বাংলা গানের ইতিহাসে প্রথম হার্ডরক গান।
আজম খান জীবনের প্রথম কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন মধুমিতা সিনেমা হলে।
পাশাপাশি ক্রিকেটার হিসেবেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
১৯৭২ সালে নটরডেম কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো দর্শকের সামনে গান গান আজম খান। ১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল বাংলাদেশে প্রথম কনসার্ট হয় ওয়াপদা মিলনায়তনে হারুন নামে জনৈক ব্যক্তির অবদানে।
১৯৭৩ সালের বন্ধু শামীম ও রুমির সঙ্গে আড়াইশ টাকা দিয়ে ইন্দিরা রোডের ঢাকা রেকর্ডিং স্টুডিওতে শিফট ভাড়া করে আজম খান ও ফেরদৌস ওয়াহিদ দু’জনে মিলে রেকর্ড করেন চারটি গান। আজম খানের তুমুল জনপ্রিয় দুই গান ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’ ও ‘হাইকোর্টের মাজারে’ সেদিন সেখানেই রেকর্ড করা হয়েছিল। ‘চাঁদ জাগে তারা জাগে’ ও ‘দুনিয়াটা কত মজার’ গান দুটি। এই গানগুলো শোনার পর স্টুডিওর মালিকের এতটাই ভালো লেগেছিল যে, তিনি তাদের গান রেকর্ড আকারে প্রকাশ করারও দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সেই গানগুলো সুপারভিশন করেছিলেন আজম খানের বড় ভাই খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক আলম খান। স্টুডিওর মালিক তাঁর কথা ফেলতে পারেন নি। প্রথম আজম খানের দুটি গান রেকর্ড আকারে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশের পরপরই গান দুটি দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে।
১৯৮২ সালে তার প্রথম ক্যাসেট ‘এক যুগ’ বের হয়। প্রথম সিডি বের হয় ১৯৯৯ সালের ৩ মে ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের প্রযোজনায়।
আজম খানের ১৭টি গানের অ্যালবামসহ বেশ কিছু মিক্সড অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তার জনপ্রিয় গানের মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু গান হলো: আমি যারে চাইরে, অভিমানী তুমি কোথায়, একদিন-তো চলে যাব, জীবনে কিছু পাব নারে, আসি আসি বলে তুমি আর এলে না, ও চাঁদ সুন্দর চাঁদ, চুপ চুপ অনামিকা চুপ, হারিয়ে গেছ খুঁজে পাব না, ঘুম আসে না-সহ আরও অসংখ্য খান
গানের বাইরেও দেশের মিডিয়ায় ১৯৮৬ সালে ‘কালা বাউল’ নামে হীরামনের একটি নাটকে এবং ২০০৩ সালে শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। ২০০৩ সালে ক্রাউন এনার্জি ড্রিংকসের বিজ্ঞাপন ও সর্বশেষ ২০১০ সালে কোবরা ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছিলেন এই পপ সম্রাট।
১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি সাহেদা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় আজম খানের। সহধর্মিণী মারা যাওয়ার পর থেকে বড় মেয়ে ইমা খান, মেজো ছেলে হৃদয় খান ও ছোট মেয়ে অরণী খান এর জনক হিসাবে একাকী জীবন কাটান এ কিংবদন্তী। সুর হয়ে ওঠে জীবনের ধ্যানজ্ঞান। সেই সুরেই এখনো সকলের অন্তরে বেঁচে আছেন তিনি। সবকিছু সহজভাবে নিতে পারতেন সবার সাথে মিশতেন, ক্রিকেট খেলতেন। অনেকে যখন তারকাখ্যাতির অহমে অন্ধ, কখনো তিনি আট-দশটা মানুষ থেকে নিজেকে আলাদা ভাবতেননা। তিনি কত বড় মাপের তারকা, কেন তাকে লোকে গুরু, কিংবদন্তি শিল্পী হিসেবে পরিচয় করায়- সেসব নিয়ে আদৌ কোনোদিন ভাবতেন না। এতটাই সাদাসিধে মানুষ ছিল আজম খান। সংগীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।