ঢাকা ১২:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম , আমৃত্যু সংগ্রামের এক নাম

১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লেখিকা, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী বাংলাদেশে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। আজকে যে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে তার প্রধান ভূমিকায় ছিলেন একজন জাহানারা ইমাম। তাঁর ডাক নাম ছিল জুড়ু। বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মা সৈয়দা হামিদা বেগম। জাহানারা ইমামের শৈশবকালে মুসলিম পরিবারে মেয়েদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। বাবার সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং বিয়ের পর স্বামীর সহযোগীতায় রক্ষণশীলতার বাইরে এসে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। এখান থেকে বিএ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করার পর ১৯৬৫ সালে বাংলায় এমএ পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। এরপর ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৫২ থেকে ১৯৬০, বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক হিসেবে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত তাঁর কর্মজীবন কাটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এ সময়টাতেই তিনি নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এক ছিমছাম সংসার আর সুখী জীবন ছিল তার। জাহানারা ইমাম তখন পুরদমে গৃহিণী আর তার স্বামী শরীফ ইমাম ‘দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের’ প্রকৌশলী। ২ সন্তান নিয়ে তাদের সাজানো সংসার। চাইলেই মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী জীবন থেকে নিজেদের আড়াল করে নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য পাড়ি জমাতে পারতেন জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। চাইলেই সেখানে গোটা মুক্তিযুদ্ধের সময় নিভৃতে নিরাপদে থাকতেন। কিন্তু তিনি ভালোবেসেছিলেন স্বদেশের মুক্তি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জাহানারা ইমামের বড় ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শাফি ইমাম রুমী শহীদ হন । ১৯৭১ সালের ২৯ অগাস্ট রুমি তাঁর নিজের বাড়িতে কাটান, সে রাতে বাসায় উপস্থিত সকল পুরুষদের এলিফ্যান্ট রোডের কনিকার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। পরে আটক অবস্থায় নির্মম নির্যাতন করা হয় রুমিসহ গ্রেফতারকৃত অন্যান্য গেরিলাদের উপর। আটকের একদিন পরেই রুমি নিখোঁজ হন এবং তাঁর লাশটিও গুম করে ফেলা হয়। এছাড়া যুদ্ধের সময় তার স্বামী মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী শরীফ ইমামও মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

১৯৮২ সালে তিনি মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। প্রতি বছর একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো তাকে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং শারীরিক অবস্থা ভঙ্গুর হওয়া সত্ত্বেও স্বদেশের জন্মশত্রু, স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে তিনি দুর্বার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। এরশাদ সরকারের পতনের পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতা নিয়ে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করলে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের নাগরিক ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী দলের আমীর ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্ষমতাসীন দলে থাকা গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। মূলত গণআদালত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে একটি দুসাহহিক প্রতীকী প্রতিবাদ। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার পরও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিটি বৈঠকেই দুর্দমনীয় মনোবল নিয়ে সশরীরে থাকতেন তিনি। আন্দোলন চালাতে গিয়ে অসুস্থ শরীরে জেলায় জেলায় ছুটে গিয়ে আন্দোলন ত্বরান্বিত করে নিজের উপার্জনের প্রায় সবই বিলিয়ে দিয়েছিলেন কর্মীদের জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় আন্দোলনকে বেগবান করতে দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর অভিযান চলল। তার তৎপরতা ও নির্ঘুম প্রচেষ্টায় বিদেশের মাটিতেও গঠিত হলো ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ছিল কে কীভাবে খাচ্ছে তারও দেখভাল করতেন তিনি। তার বাড়ি ছিল আন্দোলনের সকল সেনাদের জন্য উন্মুক্ত। তারই পদক্ষেপে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলন দৃষ্টিগোচর হয় ও সমর্থিত হয়।

 

গণআদালতের পরে সরকারপক্ষ ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করলে হাইকোর্ট সবাইকে জামিন দিলেও জাহানারা ইমামকে দেয়নি। লাখো জনতাসহ জাহানারা ইমাম ১৯৯২ সালের ১২ এপ্রিল গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবিতে তৎকালীন সরকার ও বিরোধী দলের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। ২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষণা করে আরো আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম —আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো. কামরুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আব্দুল কাদের মোল্লা। পরের বছর স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান আরেক সাহসী কবি বেগম সুফিয়া কামাল রাজপথের বিশাল জনসমাবেশে জাহানারা ইমামের হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট তুলে দেন। ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ নির্মূল কমিটির সমাবেশের পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হলে তাকে ভর্তি হতে হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। কিন্তু তিনি কখনোই জীবনের পরোয়া করেননি।
বাড়িটির নাম ‘কণিকা’। পুরনো এলিফ্যান্ট রোডের ৩৫৫ নম্বর বাড়ি। যার প্রতিটি কোণায় কোণায় ইট-কাঠ, পলেস্তরায়, দরোজা, জানালা, ঝুল বারান্দার গ্রিলে আঁকা হয়ে আছে একাত্তরের দিনগুলোর দীর্ঘশ্বাস। ইতিহাসের স্মৃতি রক্ষায় জাহানারা ইমামের কনিষ্ঠ সন্তান এবং শহীদ রুমীর ছোট ভাই সাইফ ইমাম জামীর উদ্যোগে ২০০৭ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর’। জাহানারা ইমামের কনিষ্ঠ সন্তান সাইফ ইমাম জামী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।এখনো হয়তো মা কান পেতে আছেন ওই বুঝি বাড়িতে গাড়ি ঢোকার শব্দ শোনা যায়, ওই বুঝি গাড়িটি থামলো পোর্চে। মা ছুটে যাবেন ঝুল বারান্দায়। উঁকি মেরে দেখবেন খোকা ফিরছে ঘরে ফিরছে। মায়ের চোখের তারায় ভোরের আলোর ঝিলিক। মা তাঁর প্রাণের সন্তানকে দেশের মাটিতে বলি দিয়েছিলেন সেই ১৯৭১ এর মার্চের উত্তাল সময়ে। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় আমেরিকার মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হলেও ৪ জুলাই তার মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার মৃতদেহ গ্রহণ করেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ৫ জুলাই সকালে জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিন রাখা হয়। দুপুরে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাযা শেষে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের আটজন সেক্টর কমান্ডার শহীদ জননীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। তাঁর লেখা প্রচুর বই রয়েছে এবং সমগ্র জীবনে বহু সম্মাননা পুরষ্কার পদক পেলেও সন্তানহারা মা জননী সারাজীবন রাজপথে থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত লড়ে গেছেন।

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম , আমৃত্যু সংগ্রামের এক নাম

আপডেট সময় : ০৪:৩৯:০৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ জুন ২০২৩

১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লেখিকা, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী বাংলাদেশে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। আজকে যে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে তার প্রধান ভূমিকায় ছিলেন একজন জাহানারা ইমাম। তাঁর ডাক নাম ছিল জুড়ু। বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মা সৈয়দা হামিদা বেগম। জাহানারা ইমামের শৈশবকালে মুসলিম পরিবারে মেয়েদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। বাবার সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং বিয়ের পর স্বামীর সহযোগীতায় রক্ষণশীলতার বাইরে এসে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। এখান থেকে বিএ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করার পর ১৯৬৫ সালে বাংলায় এমএ পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। এরপর ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৫২ থেকে ১৯৬০, বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক হিসেবে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত তাঁর কর্মজীবন কাটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এ সময়টাতেই তিনি নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এক ছিমছাম সংসার আর সুখী জীবন ছিল তার। জাহানারা ইমাম তখন পুরদমে গৃহিণী আর তার স্বামী শরীফ ইমাম ‘দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের’ প্রকৌশলী। ২ সন্তান নিয়ে তাদের সাজানো সংসার। চাইলেই মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী জীবন থেকে নিজেদের আড়াল করে নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য পাড়ি জমাতে পারতেন জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। চাইলেই সেখানে গোটা মুক্তিযুদ্ধের সময় নিভৃতে নিরাপদে থাকতেন। কিন্তু তিনি ভালোবেসেছিলেন স্বদেশের মুক্তি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জাহানারা ইমামের বড় ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শাফি ইমাম রুমী শহীদ হন । ১৯৭১ সালের ২৯ অগাস্ট রুমি তাঁর নিজের বাড়িতে কাটান, সে রাতে বাসায় উপস্থিত সকল পুরুষদের এলিফ্যান্ট রোডের কনিকার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। পরে আটক অবস্থায় নির্মম নির্যাতন করা হয় রুমিসহ গ্রেফতারকৃত অন্যান্য গেরিলাদের উপর। আটকের একদিন পরেই রুমি নিখোঁজ হন এবং তাঁর লাশটিও গুম করে ফেলা হয়। এছাড়া যুদ্ধের সময় তার স্বামী মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী শরীফ ইমামও মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

১৯৮২ সালে তিনি মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। প্রতি বছর একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো তাকে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং শারীরিক অবস্থা ভঙ্গুর হওয়া সত্ত্বেও স্বদেশের জন্মশত্রু, স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে তিনি দুর্বার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। এরশাদ সরকারের পতনের পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতা নিয়ে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করলে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের নাগরিক ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী দলের আমীর ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্ষমতাসীন দলে থাকা গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। মূলত গণআদালত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে একটি দুসাহহিক প্রতীকী প্রতিবাদ। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার পরও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিটি বৈঠকেই দুর্দমনীয় মনোবল নিয়ে সশরীরে থাকতেন তিনি। আন্দোলন চালাতে গিয়ে অসুস্থ শরীরে জেলায় জেলায় ছুটে গিয়ে আন্দোলন ত্বরান্বিত করে নিজের উপার্জনের প্রায় সবই বিলিয়ে দিয়েছিলেন কর্মীদের জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় আন্দোলনকে বেগবান করতে দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর অভিযান চলল। তার তৎপরতা ও নির্ঘুম প্রচেষ্টায় বিদেশের মাটিতেও গঠিত হলো ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ছিল কে কীভাবে খাচ্ছে তারও দেখভাল করতেন তিনি। তার বাড়ি ছিল আন্দোলনের সকল সেনাদের জন্য উন্মুক্ত। তারই পদক্ষেপে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলন দৃষ্টিগোচর হয় ও সমর্থিত হয়।

 

গণআদালতের পরে সরকারপক্ষ ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করলে হাইকোর্ট সবাইকে জামিন দিলেও জাহানারা ইমামকে দেয়নি। লাখো জনতাসহ জাহানারা ইমাম ১৯৯২ সালের ১২ এপ্রিল গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবিতে তৎকালীন সরকার ও বিরোধী দলের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। ২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষণা করে আরো আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম —আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো. কামরুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আব্দুল কাদের মোল্লা। পরের বছর স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান আরেক সাহসী কবি বেগম সুফিয়া কামাল রাজপথের বিশাল জনসমাবেশে জাহানারা ইমামের হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট তুলে দেন। ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ নির্মূল কমিটির সমাবেশের পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হলে তাকে ভর্তি হতে হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। কিন্তু তিনি কখনোই জীবনের পরোয়া করেননি।
বাড়িটির নাম ‘কণিকা’। পুরনো এলিফ্যান্ট রোডের ৩৫৫ নম্বর বাড়ি। যার প্রতিটি কোণায় কোণায় ইট-কাঠ, পলেস্তরায়, দরোজা, জানালা, ঝুল বারান্দার গ্রিলে আঁকা হয়ে আছে একাত্তরের দিনগুলোর দীর্ঘশ্বাস। ইতিহাসের স্মৃতি রক্ষায় জাহানারা ইমামের কনিষ্ঠ সন্তান এবং শহীদ রুমীর ছোট ভাই সাইফ ইমাম জামীর উদ্যোগে ২০০৭ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর’। জাহানারা ইমামের কনিষ্ঠ সন্তান সাইফ ইমাম জামী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।এখনো হয়তো মা কান পেতে আছেন ওই বুঝি বাড়িতে গাড়ি ঢোকার শব্দ শোনা যায়, ওই বুঝি গাড়িটি থামলো পোর্চে। মা ছুটে যাবেন ঝুল বারান্দায়। উঁকি মেরে দেখবেন খোকা ফিরছে ঘরে ফিরছে। মায়ের চোখের তারায় ভোরের আলোর ঝিলিক। মা তাঁর প্রাণের সন্তানকে দেশের মাটিতে বলি দিয়েছিলেন সেই ১৯৭১ এর মার্চের উত্তাল সময়ে। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় আমেরিকার মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হলেও ৪ জুলাই তার মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার মৃতদেহ গ্রহণ করেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ৫ জুলাই সকালে জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিন রাখা হয়। দুপুরে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাযা শেষে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের আটজন সেক্টর কমান্ডার শহীদ জননীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। তাঁর লেখা প্রচুর বই রয়েছে এবং সমগ্র জীবনে বহু সম্মাননা পুরষ্কার পদক পেলেও সন্তানহারা মা জননী সারাজীবন রাজপথে থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত লড়ে গেছেন।