আজ ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ এন্ড্রু কিশোরের তৃতীয় প্রয়াণ দিবস। ২০২০ সালের ৬ জুলাই ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। দেশজুড়ে পারিবারিকভাবে প্রার্থনাসহ বিভিন্নভাবে স্মরণ করা হচ্ছে বাংলাদেশের এই প্লে-ব্যাক সম্রাটকে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এন্ড্রু কিশোরকে প্রাথমিক ভাবে সিঙ্গাপুরে নিয়ে গেলে ১৮ সেপ্টেম্বর তার শরীরে কর্কট রোগের বাস জানা যায়। দীর্ঘ ১০টি মাস হাসিমুখে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এই কিংবদন্তী শিল্পী। চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি নিজের ইচ্ছায় আগেই দেশের মাটিতে আসতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশে গিয়ে মরতে চাই, এখানে নয়।’ ১১ জুন বিকেলে সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফেরেন তিনি। তাঁর পর দিন রাজশাহী নগরীর মহিষবাতান এলাকায় বোন শিখা বিশ্বাসের ক্লিনিকে ভর্তি হন তিনি৷ সেখানে ভগ্নিপতি ও চিকিৎসক প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। ২০ জুন তাকে নেয়া হয় রাজশাহী নগরীর মহিষবাথানে বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাসায়। দীর্ঘ ১০ মাস ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে ৬ জুলাই সন্ধ্যায় তিনি বোনের ক্লিনিকে মারা যান। তার ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে থাকায় মরদেহ সমাহিত না করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের হিমঘরে রাখা ছিলো। তার ছেলে এন্ড্রু জুনিয়র সপ্তক ৭ জুলাই এবং মেয়ে সংজ্ঞা ১৩ জুলাই দেশে ফিরলে ১৫ জুলাই রাজশাহী সার্কিট হাউস সংলগ্ন এলাকায় চার্চের নিজস্ব কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে সমাধিতে সমাহিত করা হয় এই শিল্পীকে।
১৫ হাজারেরও বেশি গান গেয়ে আগের মতোই শ্রোতাদের মণিকোঠায় জীবন্ত হয়ে আছেন এন্ড্রু কিশোর। সংগীত ক্যারিয়ারে শ্রেষ্ঠ গায়ক বিভাগে আটটি ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ জিতেছেন প্রয়াত এই গায়ক। এছাড়া দুটি ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’ ও তিনটি ‘বাচসাস’ পুরস্কার’সহ এন্ড্রু কিশোরের ঝুলিতে আছে অসংখ্য নামিদামি সম্মাননা। ১৯৭৭ সালে আলম খান সুরারোপিত ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রের ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ (১৯৮২) চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন এন্ড্রু কিশোর। এন্ডু কিশোরের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আমি চিরকাল প্রেমেরও কাঙ্গাল’ প্রভৃতি।
১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এই মহান গায়ক। এন্ড্রু কিশোরের বাবা ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ এবং মা মিনু বাড়ৈ রাজশাহী মহানগরীর বুলনপুর মিশন গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সংগীত অনুরাগী মায়ের কাছেই তার পড়াশোনার হাতেখড়ি। তাঁর মায়ের পছন্দের শিল্পী ছিলেন কিশোর কুমার তাঁর নামানুসারেই এন্ড্রু কিশোরের নাম রাখেন তাঁর মা। এন্ড্রু কিশোর ৬ বছর বয়েসে আব্দুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে প্রাথমিকভাবে সংগীত পাঠ গ্রহণ শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কিশোর নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গান শ্রেণিতে রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। কিশোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে লিপিকা এন্ড্রু ইতির সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন এন্ড্রু কিশোর। এ দম্পতির দুটি সন্তান রয়েছে। প্রথম সন্তানের নাম সংজ্ঞা আর দ্বিতীয়জনের নাম সপ্তক। মায়ের স্বপ্নপূরণ করতেই সংগীতাঙ্গনে পা রাখেন এন্ড্রু কিশোর।