সনদ ছিড়ে বাদশা হয়েছেন কৃষক , মুক্তা পেয়েছেন চাকুরি

বাদশা হয়েছেন কৃষক ।

২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে নিজের শিক্ষাজীবনে অর্জিত সকল একাডেমিক সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেন নীলফামারীর ডিমলার যুবক বাদশা মিয়া। প্রায় ২০টি সরকারিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার পরও চাকরি পাননি তিনি। এভাবে একসময়ে শেষ হয়ে যায় তার  সরকারি চাকরির বয়সের সীমা।এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের শিক্ষাজীবনে অর্জিত সকল একাডেমিক সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেন তিনি।

সে সময়ে তিনি ফেসবুক লাইভে  বলেছিলেন, আসলে আমার ভাগ্যটাই খারাপ! কত মানুষ ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়া করে খাচ্ছে। আর আমি এত সার্টিফিকেট নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও একটা সরকারি বা বেসরকারি চাকরি জোটাতে পারিনি। সার্টিফিকেট অনুযায়ী চাকরির বয়স শেষ, এখন এগুলো রেখে লাভ কী? বয়স থাকতেই তো চাকরি জোটাতে পারিনি।

সেই বাদশা মিয়া  এখন পুরোদস্তুর কৃষক ।  ডিমলা উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ সুন্দর খাতা গ্রামের ধানখেতে কাজ করছেন বাবার সাথে । তীব্র রোদ উপেক্ষা করে নিজের জমির ধান কেটে কাঁধে নিয়ে বাড়ির উঠানে নিয়ে আসছেন ওই যুবক। বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে মাঠের কাজে সহযোগিতা করছেন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে সংসারের হাল ধরেছেন বাদশা। সামান্য আবাদি জমির ফসল দিয়ে কোনো রকমে দিনযাপন করছে তাঁর পরিবার।

বাদশার বাবা মহুবার রহমান বলেন, ‘চাকরির বয়সসীমা শেষ হওয়ায় বেশ কিছুদিন থেকে হতাশায় ভুগছিল বাদশা। দিনে দিনে হতাশা বেড়ে যাওয়ায় সে তার একাডেমিক সার্টিফিকেটগুলো কাউকে না জানিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। বর্তমানে সংসার চালানো খুবই কষ্টকর। নিজের মাত্র তিন বিঘা জমি। তিন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর এখন সঞ্চয় বলে কিছু নেই। ছোট ছেলে বিএ পড়ছে। সবকিছু মিলে বেকার ছেলে বাদশাকে নিয়ে মাঠে কাজ করছি। ’

বাদশা মিয়া বলেন, ‘আমার বাবা খেয়ে না খেয়ে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা ও ছোট ভাইবোনদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অসহায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলে। এরা না পারে চাকরি জোটাতে, আবার অর্থের অভাবে না পারে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। তাই চুপিসারে ঢাকা ও বগুড়া শহরে প্রায় সময়ে রিকশা চালিয়ে উপার্জন করেছি। এলাকার কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জায়গায় কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। ’

বাদশা  আরও বলেন, ‘সনদ ছিঁড়ে ফেলার পর রোজ নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিস আমাকে চাকরি দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তিন মাস চাকরি করার পর এক মাসের বেতন দেওয়ায় চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি। অপর দিকে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঢাকায় কনস্ট্রাকশনের কাজে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে শ্রমিক হিসেবে আমাকে দৈনিক হাজিরায় কাজ দেওয়ায় তা ছেড়ে চলে আসি। ’

এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, চাকরি ছেড়ে চলে আসার বিষয়টি জানা ছিল না। বাদশা যদি চায় তাহলে তাকে আইসিটি কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা হবে। পরবর্তীতে সেই দক্ষতা ভিত্তিক চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে।

অপর দিকে , সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে নিজের সব শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ পুড়িয়েছিলেন মুক্তা সুলতানা নামে এক তরুণী। কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার বনগ্রামের এই তরুণী ২০১৯ সালে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হয়। সেই তরুণীকে এবার চাকরি দিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

মুক্তা পেয়েছেন চাকুরি ।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে ২৭ বছরের অর্জিত সব অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলেন এই তরুণী। বিষয়টি নজরে এলে তাকে নিজের দফতরে আসতে বলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তার সঙ্গে আলোচনার পর প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মুক্তাকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব সিকিউরড ইমেইল ফর গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার’ প্রজেক্টে ‘কন্টেন্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল কমিউনিকেশন অফিসার’ পদে চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেন। তার বেতন ৩৫ হাজার টাকা।

সামাজিক মাধ্যমে হতাশাগ্রস্থ বেকার দু’জনের এই ধরনের ঘটনায়  ভিন্ন ফলাফলে সর্বমহলে চলছে সমালোচনা । এমন অনেক যুবক-যুবতী  রয়েছেন যাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা  থাকার পরও তারা চাকুরি  পান নি । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ব্যঙ্গ করে মন্তব্য করেন –  তাহলে সকল বেকার  যদি  হতাশ হয়ে বয়স শেষ হওয়ার পর এভাবে সনদ ছিড়ে ফেলে বা আগুন দেয় তারাও কি চাকুরি পাবে ?  সমাজের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন গুণীজনেরা । নতুবা , সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষা নিয়ে ভুল বার্তা যাবে , যা দেশ-জাতির জন্য সুখকর নয় ।

ট্যাগস :

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

সনদ ছিড়ে বাদশা হয়েছেন কৃষক , মুক্তা পেয়েছেন চাকুরি

আপডেট সময় : ০৮:৫৫:১৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ জুন ২০২৩

২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে নিজের শিক্ষাজীবনে অর্জিত সকল একাডেমিক সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেন নীলফামারীর ডিমলার যুবক বাদশা মিয়া। প্রায় ২০টি সরকারিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার পরও চাকরি পাননি তিনি। এভাবে একসময়ে শেষ হয়ে যায় তার  সরকারি চাকরির বয়সের সীমা।এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের শিক্ষাজীবনে অর্জিত সকল একাডেমিক সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেন তিনি।

সে সময়ে তিনি ফেসবুক লাইভে  বলেছিলেন, আসলে আমার ভাগ্যটাই খারাপ! কত মানুষ ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়া করে খাচ্ছে। আর আমি এত সার্টিফিকেট নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও একটা সরকারি বা বেসরকারি চাকরি জোটাতে পারিনি। সার্টিফিকেট অনুযায়ী চাকরির বয়স শেষ, এখন এগুলো রেখে লাভ কী? বয়স থাকতেই তো চাকরি জোটাতে পারিনি।

সেই বাদশা মিয়া  এখন পুরোদস্তুর কৃষক ।  ডিমলা উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ সুন্দর খাতা গ্রামের ধানখেতে কাজ করছেন বাবার সাথে । তীব্র রোদ উপেক্ষা করে নিজের জমির ধান কেটে কাঁধে নিয়ে বাড়ির উঠানে নিয়ে আসছেন ওই যুবক। বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে মাঠের কাজে সহযোগিতা করছেন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে সংসারের হাল ধরেছেন বাদশা। সামান্য আবাদি জমির ফসল দিয়ে কোনো রকমে দিনযাপন করছে তাঁর পরিবার।

বাদশার বাবা মহুবার রহমান বলেন, ‘চাকরির বয়সসীমা শেষ হওয়ায় বেশ কিছুদিন থেকে হতাশায় ভুগছিল বাদশা। দিনে দিনে হতাশা বেড়ে যাওয়ায় সে তার একাডেমিক সার্টিফিকেটগুলো কাউকে না জানিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। বর্তমানে সংসার চালানো খুবই কষ্টকর। নিজের মাত্র তিন বিঘা জমি। তিন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর এখন সঞ্চয় বলে কিছু নেই। ছোট ছেলে বিএ পড়ছে। সবকিছু মিলে বেকার ছেলে বাদশাকে নিয়ে মাঠে কাজ করছি। ’

বাদশা মিয়া বলেন, ‘আমার বাবা খেয়ে না খেয়ে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা ও ছোট ভাইবোনদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অসহায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলে। এরা না পারে চাকরি জোটাতে, আবার অর্থের অভাবে না পারে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। তাই চুপিসারে ঢাকা ও বগুড়া শহরে প্রায় সময়ে রিকশা চালিয়ে উপার্জন করেছি। এলাকার কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জায়গায় কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। ’

বাদশা  আরও বলেন, ‘সনদ ছিঁড়ে ফেলার পর রোজ নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিস আমাকে চাকরি দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তিন মাস চাকরি করার পর এক মাসের বেতন দেওয়ায় চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি। অপর দিকে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঢাকায় কনস্ট্রাকশনের কাজে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে শ্রমিক হিসেবে আমাকে দৈনিক হাজিরায় কাজ দেওয়ায় তা ছেড়ে চলে আসি। ’

এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, চাকরি ছেড়ে চলে আসার বিষয়টি জানা ছিল না। বাদশা যদি চায় তাহলে তাকে আইসিটি কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা হবে। পরবর্তীতে সেই দক্ষতা ভিত্তিক চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে।

অপর দিকে , সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে নিজের সব শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ পুড়িয়েছিলেন মুক্তা সুলতানা নামে এক তরুণী। কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার বনগ্রামের এই তরুণী ২০১৯ সালে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হয়। সেই তরুণীকে এবার চাকরি দিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

মুক্তা পেয়েছেন চাকুরি ।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে ২৭ বছরের অর্জিত সব অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলেন এই তরুণী। বিষয়টি নজরে এলে তাকে নিজের দফতরে আসতে বলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তার সঙ্গে আলোচনার পর প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মুক্তাকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব সিকিউরড ইমেইল ফর গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার’ প্রজেক্টে ‘কন্টেন্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল কমিউনিকেশন অফিসার’ পদে চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেন। তার বেতন ৩৫ হাজার টাকা।

সামাজিক মাধ্যমে হতাশাগ্রস্থ বেকার দু’জনের এই ধরনের ঘটনায়  ভিন্ন ফলাফলে সর্বমহলে চলছে সমালোচনা । এমন অনেক যুবক-যুবতী  রয়েছেন যাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা  থাকার পরও তারা চাকুরি  পান নি । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ব্যঙ্গ করে মন্তব্য করেন –  তাহলে সকল বেকার  যদি  হতাশ হয়ে বয়স শেষ হওয়ার পর এভাবে সনদ ছিড়ে ফেলে বা আগুন দেয় তারাও কি চাকুরি পাবে ?  সমাজের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন গুণীজনেরা । নতুবা , সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষা নিয়ে ভুল বার্তা যাবে , যা দেশ-জাতির জন্য সুখকর নয় ।