অজ্ঞতা ও অপ্রয়োজনীয় সিজার

হাসপাতালগুলোতে সিজারিয়ান সেকশনের হার নিয়ে আমরা অনেকেই উদ্বিগ্ন। প্রথম বাচ্চা সি সেকশনে হলে পরবর্তীতে নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যায়, কারণ VBAC (Vaginal birth after Cesarean section) এর ফ্যাসিলিটি সহজলভ্য না, সবক্ষেত্রে সম্ভবও না। তাই যদি আমরা সি-সেকশনের হার কমাতে চাই, অবশ্যই আমাদের প্রাথমিক সিজারিয়ান সেকশনের হার কমানোর চেষ্টা করতে হবে।

কি কি কারণে প্রাথমিক সি-সেকশন হয়?

কিছু ক্ষেত্রে, যেমন, প্লাসেন্টা প্রিভিয়া অর্থাৎ প্লাসেন্টা নিচের দিকে থাকলে, বাচ্চা ব্রিচ বা আড়াআড়ি পজিশনে থাকলে, মার অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বা খিঁচুনি হলে, বাচ্চার গ্রোথ কম হলে বা এমনিওটিক ফ্লুয়িড অনেক বেশি কমে গেলে, লেবার চলাকালীন মা বা বাচ্চার অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে, ইত্যাদি বেশ কিছু কারণ আছে যখন নরমাল ডেলিভারি মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় এবং সি সেকশনে যেতে হয়। এটা এড়ানোর উপায় নাই।
এর বাইরে আরো কিছু কারণে সি সেকশন হয় যেগুলো চাইলে এড়ানো সম্ভব।

কি সেই সব কারণ?

– আজকাল সি সেকশনের একটা ইন্ডিকেশন ইচ্ছাকৃত সি-সেকশন বা On Demand CS। অর্থাৎ মা, সেইসাথে তার ফ্যামিলির সবাইও ডক্টরের কাছে ডিরেক্টলি সি সেকশন ডিমান্ড করে। তারা বলেই দেয় যে তারা কোনভাবেই নরমাল ডেলিভারি করাবে না। কেন এই ইচ্ছাকৃত সি-সেকশন?

এর পিছনে প্রধান কারণ লেবার পেইনকে ভয় পাওয়া। কেন লেবার পেইনকে ভয়? হতে পারে লেবার পেইন সম্পর্কে কোন ধারণা নাই । তাই যেমন আমরা অজানা জিনিসকে ভয় পাই, অন্ধকারকে ভয় পাই, সেই রকম না জানার কারণে লেবার পেইন নিয়েও মনে অনেক ভয় কাজ করে। আবার আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আমাদের ভাবনাকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। তাই যখন পরিবার বা আশেপাশের কারো যদি ট্রমাটিক নরমাল ডেলিভারির হিস্ট্রি থাকে, সেটা নরমাল ডেলিভারি সম্পর্কে মনে অজানা ভীতির সৃষ্টি করে।

এর বাইরে কিছু সংখ্যক মায়েরা আছেন যারা মন থেকে নরমাল ডেলিভারি চান এবং লেবার পেইন উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে তখনই যখন চাওয়ার সাথে জ্ঞান ও প্রস্তুতির সমন্বয় থাকে না। তাই পেইন কোপিং ম্যানেজমেন্ট জানা না থাকার কারণে পেইন টলারেট করতে না পেরে একটা পর্যায়ে তারা হাল ছেড়ে দেয়।
-এছাড়া perineal tear বা episiotomy সম্পর্কে ভুল ধারণা থেকেও অনেকে ভয় পেয়ে সেটা এড়াতে সি সেকশনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সি সেকশনের কাটা যে এর চেয়ে অনেক বেশি এবং কমপ্লিকেশনের সম্ভাবনা এক্ষেত্রে বেশি, সেই জ্ঞানটা অনেকের থাকে না।
– অপ্রয়োজনীয় সি সেকশনের পিছনে আরেকটা কারণ থাকে কিছু চিকিৎসকের অসাধুতা। চিকিৎসকেরাও যেহেতু মানুষ, তাই দুঃখজনকভাবে অন্যান্য প্রফেশনের মত এক্ষেত্রেও কিছু ডাক্তার আমাদের সমাজে আছে যাদের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। কখনো কখনো মায়েদের নরমাল ডেলিভারি হবে না বা কমপ্লিকেশন হবে, এই ধরনের কথা বলে তারা সি সেকশনের দিকে নিয়ে যেতে চায়। সেক্ষেত্রেও কিন্তু আমাদের যদি এই ব্যাপারে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকে, তাহলে আমরা ডাক্তারকে প্রশ্ন করতে পারব, প্রয়োজনে আরেকজন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব। আমাদের জ্ঞান, সেই সাথে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার উপর তাওয়াককুল আমাদের পথ দেখাবে ইনশাআল্লাহ।

তাহলে দেখতে পাচ্ছি সি সেকশন হওয়ার পিছনে বড় একটা অংশ জুড়ে আছে আমাদের অজ্ঞতা । তাই যদি অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারি এড়াতে চাই, তাহলে জ্ঞান অর্জন ও নিজেকে সেই অনুযায়ী প্রস্তুত করার বিকল্প নাই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আমাদের উপকারী জ্ঞান অর্জন করার ও জীবনে তা প্রয়োগ করার তৌফিক দান করুন।

ডাঃ ফাতেমা ইয়াসমিন
অবস্টেট্রিশিয়ান ও গাইনোকোলজিস্ট
শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষাযিত হাসপাতাল
ইন্সট্রাকটর, রৌদ্রময়ী প্রিন্যাটাল কোর্স

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

অজ্ঞতা ও অপ্রয়োজনীয় সিজার

আপডেট সময় : ০৫:০৮:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ অক্টোবর ২০২৩

হাসপাতালগুলোতে সিজারিয়ান সেকশনের হার নিয়ে আমরা অনেকেই উদ্বিগ্ন। প্রথম বাচ্চা সি সেকশনে হলে পরবর্তীতে নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যায়, কারণ VBAC (Vaginal birth after Cesarean section) এর ফ্যাসিলিটি সহজলভ্য না, সবক্ষেত্রে সম্ভবও না। তাই যদি আমরা সি-সেকশনের হার কমাতে চাই, অবশ্যই আমাদের প্রাথমিক সিজারিয়ান সেকশনের হার কমানোর চেষ্টা করতে হবে।

কি কি কারণে প্রাথমিক সি-সেকশন হয়?

কিছু ক্ষেত্রে, যেমন, প্লাসেন্টা প্রিভিয়া অর্থাৎ প্লাসেন্টা নিচের দিকে থাকলে, বাচ্চা ব্রিচ বা আড়াআড়ি পজিশনে থাকলে, মার অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বা খিঁচুনি হলে, বাচ্চার গ্রোথ কম হলে বা এমনিওটিক ফ্লুয়িড অনেক বেশি কমে গেলে, লেবার চলাকালীন মা বা বাচ্চার অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে, ইত্যাদি বেশ কিছু কারণ আছে যখন নরমাল ডেলিভারি মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় এবং সি সেকশনে যেতে হয়। এটা এড়ানোর উপায় নাই।
এর বাইরে আরো কিছু কারণে সি সেকশন হয় যেগুলো চাইলে এড়ানো সম্ভব।

কি সেই সব কারণ?

– আজকাল সি সেকশনের একটা ইন্ডিকেশন ইচ্ছাকৃত সি-সেকশন বা On Demand CS। অর্থাৎ মা, সেইসাথে তার ফ্যামিলির সবাইও ডক্টরের কাছে ডিরেক্টলি সি সেকশন ডিমান্ড করে। তারা বলেই দেয় যে তারা কোনভাবেই নরমাল ডেলিভারি করাবে না। কেন এই ইচ্ছাকৃত সি-সেকশন?

এর পিছনে প্রধান কারণ লেবার পেইনকে ভয় পাওয়া। কেন লেবার পেইনকে ভয়? হতে পারে লেবার পেইন সম্পর্কে কোন ধারণা নাই । তাই যেমন আমরা অজানা জিনিসকে ভয় পাই, অন্ধকারকে ভয় পাই, সেই রকম না জানার কারণে লেবার পেইন নিয়েও মনে অনেক ভয় কাজ করে। আবার আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আমাদের ভাবনাকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। তাই যখন পরিবার বা আশেপাশের কারো যদি ট্রমাটিক নরমাল ডেলিভারির হিস্ট্রি থাকে, সেটা নরমাল ডেলিভারি সম্পর্কে মনে অজানা ভীতির সৃষ্টি করে।

এর বাইরে কিছু সংখ্যক মায়েরা আছেন যারা মন থেকে নরমাল ডেলিভারি চান এবং লেবার পেইন উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে তখনই যখন চাওয়ার সাথে জ্ঞান ও প্রস্তুতির সমন্বয় থাকে না। তাই পেইন কোপিং ম্যানেজমেন্ট জানা না থাকার কারণে পেইন টলারেট করতে না পেরে একটা পর্যায়ে তারা হাল ছেড়ে দেয়।
-এছাড়া perineal tear বা episiotomy সম্পর্কে ভুল ধারণা থেকেও অনেকে ভয় পেয়ে সেটা এড়াতে সি সেকশনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সি সেকশনের কাটা যে এর চেয়ে অনেক বেশি এবং কমপ্লিকেশনের সম্ভাবনা এক্ষেত্রে বেশি, সেই জ্ঞানটা অনেকের থাকে না।
– অপ্রয়োজনীয় সি সেকশনের পিছনে আরেকটা কারণ থাকে কিছু চিকিৎসকের অসাধুতা। চিকিৎসকেরাও যেহেতু মানুষ, তাই দুঃখজনকভাবে অন্যান্য প্রফেশনের মত এক্ষেত্রেও কিছু ডাক্তার আমাদের সমাজে আছে যাদের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। কখনো কখনো মায়েদের নরমাল ডেলিভারি হবে না বা কমপ্লিকেশন হবে, এই ধরনের কথা বলে তারা সি সেকশনের দিকে নিয়ে যেতে চায়। সেক্ষেত্রেও কিন্তু আমাদের যদি এই ব্যাপারে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকে, তাহলে আমরা ডাক্তারকে প্রশ্ন করতে পারব, প্রয়োজনে আরেকজন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব। আমাদের জ্ঞান, সেই সাথে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার উপর তাওয়াককুল আমাদের পথ দেখাবে ইনশাআল্লাহ।

তাহলে দেখতে পাচ্ছি সি সেকশন হওয়ার পিছনে বড় একটা অংশ জুড়ে আছে আমাদের অজ্ঞতা । তাই যদি অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারি এড়াতে চাই, তাহলে জ্ঞান অর্জন ও নিজেকে সেই অনুযায়ী প্রস্তুত করার বিকল্প নাই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আমাদের উপকারী জ্ঞান অর্জন করার ও জীবনে তা প্রয়োগ করার তৌফিক দান করুন।

ডাঃ ফাতেমা ইয়াসমিন
অবস্টেট্রিশিয়ান ও গাইনোকোলজিস্ট
শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষাযিত হাসপাতাল
ইন্সট্রাকটর, রৌদ্রময়ী প্রিন্যাটাল কোর্স